নবজাতকের জন্মের পর থেকে তার সুস্থতা ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী টিকা দেওয়া খুবই জরুরি। টিকা শুধু শিশুকে বিভিন্ন রোগ থেকে সুরক্ষিতই রাখে না, বরং অনেক মারাত্মক সংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমিয়ে তার দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে। নতুন বাবা-মা হিসেবে অনেকেরই টিকাদান প্রক্রিয়া সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা না থাকায় নবজাতকের জন্য কোন কোন টিকা কখন প্রয়োজন তা জানা নেই।
এই ব্লগে আমরা তুলে ধরব নবজাতকের টিকার তালিকা - কখন কোনটি দিতে হবে। একজন অবিভাবক হিসেবে আপনার উচিত জন্মের পর শিশুর টিকা নিশ্চিত করা। বিসিজি (BCG), পোলিও (OPV) এবং হেপাটাইটিস বি নবজাতক জীবনের প্রথম কয়েকদিনের মধ্যেই দেওয়া হয় বলে একে নবজাতক শিশুর প্রথম টিকা বলা হয়। এগুলো টিবি, পোলিও এবং হেপাটাইটিসের মত মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে প্রাথমিক সুরক্ষা দেয়।
এরপর নির্দিষ্ট সময় পরপর শিশুর বয়স অনুযায়ী ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, টিটেনাস, হাম, রুবেলা, মেনিনজাইটিসসহ আরও বিভিন্ন রোগের টিকা দেওয়া হয়। প্রতিটি টিকার নির্দিষ্ট কার্যকারিতা এবং প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, যা শিশুর বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।
শিশু জন্মের পর থেকে তার সুরক্ষার জন্য সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে বিভিন্ন টিকাদান কর্মসূচী আয়োজন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর মান ও নির্দেশনা অনুযায়ী এসকল টিকা অতি সাবধানতার সহিত সঠিক পরিমানে শিশুর যথাযথ বয়সে প্রদান করা হয়।
নিচে আমরা বেসরকারি টিকার তালিকা এবং বাচ্চাদের সরকারি টিকার তালিকা বয়স, জেন্ডার, কোথায় দেয়া যাবে, এটি কি আবশ্যক কিনা, ইত্যাদির আলোকে তুলে ধরব।
রোগের নাম |
টিকার নাম |
ডোজের সংখ্যা |
ডোজের মধ্যে বিরতি |
টিকা শুরু করার সঠিক বয়স |
জেন্ডার |
টিকা দানের স্থান |
আবশ্যক কিনা |
যক্ষা |
বিসিজি |
১ |
জন্মের পর থেকে |
ছেলে -মেয়ে |
সরকারি হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক, টিকা কেন্দ্র |
হ্যাঁ | |
ডিফথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টাংকার, হেপাটাইটিস-বি,হিমোফাইলাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি |
পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন ডিপিটি হেপাটাইটিস- বি, হিব |
৩ |
৪ সপ্তাহ |
৬ সপ্তাহ থেকে |
ছেলে- মেয়ে |
সরকারি হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক, টিকা কেন্দ্র |
হ্যাঁ |
নিউমোকক্কাল জনিত নিউমোনিয়া |
পিসিভি ভ্যাকসিন |
৩ |
৪ সপ্তাহ |
৬ সপ্তাহ থেকে |
ছেলে-মেয়ে |
সরকারি হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক, টিকা কেন্দ্র |
হ্যাঁ |
পোলিও মাইলাইটিস |
ওপিভি |
৪ |
৪ সপ্তাহ |
৬ সপ্তাহ থেকে |
ছেলে-মেয়ে |
সরকারি হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক, টিকা কেন্দ্র |
হ্যাঁ |
হাম ও রুবেলা |
এমআর টিকা |
১ |
৯ মাস বয়স পূর্ণ হলে |
ছেলে-মেয়ে |
সরকারি হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক, টিকা কেন্দ্র |
হ্যাঁ | |
ধনুষ্টংকার |
টিটি |
১ |
১৫ মাস বয়স পূর্ণ হলে |
ছেলে-মেয়ে |
সরকারি হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক, টিকা কেন্দ্র |
হ্যাঁ |
ওপিভি টিকা চার ডোজ দিতে হবে। ৪র্থ ডোজটি এমআর টিকার সাথে দিতে হবে। এছাড়া ও জন্মের ১৪ দিনের মধ্যে ওপিভির অতিরিক্ত ডোজ দেয়া যায়।
সরকারি টিকাদান কর্মসূচীর পাশাপাশি শিশুদের বেসরকারি পর্যায়েও নানা ধরনের টিকা দেওয়া হয়।
রোগের নাম |
ডোজের সংখ্যা |
টিকা শুরু করার সঠিক বয়স |
জেন্ডার |
টিকা দানের স্থান |
আবশ্যক কিনা |
বিসিজি (BCG), ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন (OPV), হেপাটাইটিস বি |
১ |
জন্মের ২৪ ঘন্টার মধ্যে |
ছেলে-মেয়ে |
ফার্মেসী, প্রাইভেট হাসপাতাল,কমিউনিটি ক্লিনিক |
না |
জলাতঙ্ক |
১ |
জন্মের পর থেকেই |
ছেলে-মেয়ে |
ফার্মেসী, প্রাইভেট হাসপাতাল,কমিউনিটি ক্লিনিক |
না |
কলেরা |
১ |
দেড় মাসের পর থেকে |
ছেলে-মেয়ে |
প্রাইভেট হাসপাতাল,কমিউনিটি ক্লিনিক |
না |
ইনফ্লুয়েঞ্জা |
১ |
৬ মাস বয়স পূর্ণ হলে |
ছেলে-মেয়ে |
প্রাইভেট হাসপাতাল,কমিউনিটি ক্লিনিক |
না |
চিকেন পক্স বা জলবসন্ত |
১ |
১২ মাস বয়স পূর্ণ হলে |
ছেলে-মেয়ে |
প্রাইভেট হাসপাতাল,কমিউনিটি ক্লিনিক |
না |
মেনিনজাইটিস |
১ |
১ বছর বয়স পূর্ণ হলে |
ছেলে-মেয়ে |
প্রাইভেট হাসপাতাল,কমিউনিটি ক্লিনিক |
না |
হেপাটাইটিস ‘এ’ |
১ |
১৮ মাসের পর থেকে |
ছেলে-মেয়ে |
প্রাইভেট হাসপাতাল,কমিউনিটি ক্লিনিক |
না |
টাইফয়েড |
১ |
দুই বছর পর থেকে |
ছেলে-মেয়ে |
প্রাইভেট হাসপাতাল,কমিউনিটি ক্লিনিক |
না |
শিশু বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
সাধারণত টিকা তিনটি প্রধান ধাপে দেওয়া হয়ঃ
জন্মের সময়: জন্মের পর প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাচ্চা -কে টিবি, হেপাটাইটিস বি এবং পোলিওর মত প্রাথমিক টিকা দেওয়া হয়, যা মারাত্মক সংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় সাহায্য করে।
নির্দিষ্ট বয়সে টিকা: জন্মের পর ৬ সপ্তাহ থেকে শুরু করে ১২-১৮ মাস বয়স পর্যন্ত নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন টিকা দেওয়া হয়, যেমন ডিপথেরিয়া, কক্লাস, টিটেনাস, হাম-রুবেলা, এবং মেনিনজাইটিসের টিকা। এই টিকাগুলি নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে দেওয়া হয় যাতে শিশুর শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা আরও শক্তিশালী হয়।
বুস্টার ডোজ: কিছু টিকার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বয়সে পুনরায় বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়। এটি শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর রাখতে সাহায্য করে।
শিশুর টিকাদান নির্দিষ্ট সময়সূচী অনুযায়ী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শিশুদের শরীরে সময়মতো প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তবে নানা কারণে টিকা দিতে দেরি হতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। প্রথমত, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বা স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সঠিক পরামর্শ নিন। তারা বাচ্চার টিকার জন্য একটি নতুন সময়সূচী নির্ধারণ করতে পারে।
এছাড়া, ক্যাচ-আপ ডোজের মাধ্যমে মিস হওয়া টিকার ঘাটতি পূরণ করা যেতে পারে, যা অনেক টিকার ক্ষেত্রে অনুমোদিত। স্বাস্থ্যকর্মীরা ক্যাচ-আপ ডোজের একটি পরিকল্পনা দিয়ে শিশুকে সঠিক সময়সূচীতে ফিরিয়ে আনতে পারেন। পরবর্তী টিকাগুলি যাতে সময়মতো দেওয়া হয়, তার জন্য টিকাদান রেকর্ড সংরক্ষণ করা এবং স্মারক,নোট অথবা ইপিআই টিকা কার্ড ব্যবহার করা যেতে পারে।
শিশুর টিকাদানের নির্দিষ্ট সময়সূচী অনেক বাবা-মায়ের জন্য কঠিন মনে হতে পারে। ব্যস্ততার কারণে কোনো টিকা দিতে ভুলে যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে দুশ্চিন্তার কারণ নেই—টিকা দিতে ভুলে গেলে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শিশুর স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করুন: প্রথমে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যোগাযোগ করুন এবং তাদের টিকাদানের তারিখ সম্পর্কে জানিয়ে দিন। বিশেষজ্ঞরা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন এবং কোন টিকা কখন দেওয়া উচিত সে সম্পর্কে একটি নতুন সময়সূচী নির্ধারণ করবেন।
ক্যাচ-আপ ডোজ সম্পন্ন করুন: অনেক টিকার ক্ষেত্রে "ক্যাচ-আপ" ডোজ দেওয়ার সুযোগ থাকে, যা মিস হওয়া টিকার প্রতিস্থাপন হিসেবে কাজ করে। এই ক্যাচ-আপ ডোজগুলো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই দেওয়া উচিত যাতে শিশুর প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনরায় স্থাপিত হয়।
পরবর্তী টিকার সময়সূচী নির্ধারণ করুন: ভুলে যাওয়া টিকাগুলি দেয়ার জন্য পরবর্তী সময়সূচী নির্ধারণ করুন এবং তা একটি নোট বা স্মারক হিসেবে সংরক্ষণ করুন। এভাবে আপনি পরবর্তী ডোজগুলি সঠিক সময়ে দিতে পারবেন।
আপনার সোনামণির যত্নে আরোগ্য আছে আপনার পাশে
উপসংহার
আমরা জানলাম নবজাতকের টিকার তালিকা - কখন কোনটি দিতে হবে। শিশুর সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য সঠিক সময়ে টিকা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টিকাদান শিশুর শরীরে বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে এবং তাকে মারাত্মক সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। তাই সঠিক টিকাদান পরিকল্পনা এবং নিয়ম মেনে চললে শিশুর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো সম্ভব।
শিশুদের ছয়টি জরুরি টিকার নাম ও দেওয়ার সময়
শিশুর জন্য ছয়টি জরুরি টিকা এবং তাদের দেওয়ার সময় নিচে দেওয়া হলো:
১। বিসিজি (BCG): জন্মের পরপরই বা এক সপ্তাহের মধ্যে—টিবি রোগ প্রতিরোধে।
২। হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B): জন্মের প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে—হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে।
৩। ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন (OPV): জন্মের পরপর ও ৬ সপ্তাহ, ১০ সপ্তাহ, ১৪ সপ্তাহ বয়সে—পোলিও রোগ প্রতিরোধে।
৪। ডিপথেরিয়া, কক্লাস ও টিটেনাস (DPT): ৬ সপ্তাহ, ১০ সপ্তাহ, ১৪ সপ্তাহ বয়সে—ডিপথেরিয়া, কক্লাস, ও টিটেনাস থেকে সুরক্ষায়।
৫। হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি (HiB): ৬ সপ্তাহ, ১০ সপ্তাহ, ১৪ সপ্তাহ বয়সে—মেনিনজাইটিস এবং নিউমোনিয়া প্রতিরোধে।
৬। হাম-রুবেলা (MR): ৯ মাস এবং ১৫ মাস বয়সে—হাম ও রুবেলা থেকে সুরক্ষায়।
শিশুদের মোট কয়টি টিকা দিতে হয়?
শিশুদের জীবনের প্রথম দুই বছরে মোট ১১টি মূল টিকা দেওয়া হয়, যার মধ্যে বিসিজি, হেপাটাইটিস বি, যক্ষ্মা, হুপিংকাশি, হাম, পোলিও-মাইটিস, ডিপথেরিয়া, কক্লাস, টিটেনাস, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি, এবং হাম-রুবেলার মতো টিকা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
পোলিও টিকা খাওয়ানোর নিয়ম কি?
পোলিও টিকা সাধারণত শিশুদের মুখে খাওয়ানো হয় (ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন বা OPV)। প্রথম ডোজ জন্মের পরপরই দেওয়া হয় এবং পরবর্তী ডোজগুলো ৬ সপ্তাহ, ১০ সপ্তাহ, এবং ১৪ সপ্তাহ বয়সে দেওয়া হয়। এছাড়া সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বিশেষ পোলিও ক্যাম্পেইনের সময় শিশুদের অতিরিক্ত ডোজ দেওয়া হয়।
জন্মের পর পর কোন টিকা দিতে হয়?
জন্মের পর পরই নবজাতককে সাধারণত তিনটি টিকা দেওয়া হয়:
বিসিজি (BCG): টিবি প্রতিরোধে।
ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন (OPV): পোলিও প্রতিরোধে।
হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B): হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষায়।
ইপিআই টিকা কয়টি ও কি কি?
ইপিআই (Expanded Program on Immunization) প্রোগ্রামের অধীনে শিশুদের ১১ টি রোগের টিকা দেওয়া হয়, যা হলোঃ
১। যক্ষ্মা
২। পোলিও-মাইটিস
৩। ডিপথেরিয়া
৪। হুপিংকাশি
৫। ধনুষ্টংকার
৬। হিমোফাইলাস বি
৭। ইনফ্লুঞ্জা
৮। হেপাটাসিস বি
৯। নিউমোকক্কাল নিঊমোনিয়া
১০। হাম ও রুবেলা
১১। ধনুষ্টংকার
Was this post helpful?
0
0