ভাইরাস জ্বর আমাদের জীবনে একটি পরিচিত সমস্যা, যা সাধারণত ঋতু পরিবর্তন বা ঠান্ডা আবহাওয়ায় বাড়ে। এই ধরনের জ্বর ভাইরাসের সংক্রমণে ঘটে, যা দ্রুত একজন থেকে অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে। ভাইরাল জ্বরের লক্ষণ সাধারণত তীব্র হলেও, সঠিক চিকিৎসা ও বিশ্রামের মাধ্যমে দ্রুতই সুস্থ হওয়া যায়। অনেক সময় এই জ্বর সাধারণ মনে হলেও অবহেলা করলে শারীরিক জটিলতার কারণ হতে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, গলা ব্যথা, এবং শরীরে দুর্বলতা- এসব সাধারণ লক্ষণ দিয়ে ভাইরাল জ্বর শুরু হয়। ভাইরাসজনিত সংক্রমণের কারণে হওয়া এই জ্বরের মূল কারণ ও প্রতিকারের উপায় জানা থাকলে দ্রুত আরোগ্য সম্ভব। তাই ভাইরাল জ্বর সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা জরুরি। এই লেখায় ভাইরাস জ্বরের কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার এবং প্রতিরোধের উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
ভাইরাল জ্বর এমন একটি জ্বর যা ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে হয়। এই জ্বরের বিশেষত্ব হলো শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, যা ভাইরাসের বিরুদ্ধে শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় করে। ভাইরাল জ্বর সাধারণত ৩-৫ দিনের মধ্যে সেরে যায়, তবে গুরুতর ক্ষেত্রে এই জ্বর দুই সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। সাধারণত মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা প্রায় 37.1°C বা 98.4°F হয়। যদি শরীরের তাপমাত্রা এর থেকে বেড়ে যায়, তখন তা জ্বর হিসাবে ধরা হয়। ভাইরাল জ্বর কখনো কম তাপমাত্রার হতে পারে (100°F এর কম), আবার কখনো ডেঙ্গুর মতো সংক্রমণের ক্ষেত্রে তা বেশি তাপমাত্রারও (100°F এর বেশি) হতে পারে। ভাইরাল জ্বর সাধারণত ঋতু পরিবর্তনের সময় বেশি হয় এবং এই জ্বরের লক্ষণগুলো অনেক সময় তীব্র হয়।
ভাইরাল জ্বরের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে, যা বিভিন্ন ভাইরাসের কারণে হয়ে থাকে। এখানে কিছু সাধারণ ভাইরাল জ্বর সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাল জ্বর: এই ধরনের জ্বর শ্বাসনালির ভাইরাস সংক্রমণের কারণে হয় এবং এতে সাধারণত কাশি, সর্দি, গলা ব্যথা, শরীরে ব্যথা, তীব্র ক্লান্তি এবং জ্বর দেখা যায়। এটা সাধারণত ঠান্ডা আবহাওয়ায় বেশি হয় এবং খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। উদাহরণ হিসেবে, ফ্লু (ইনফ্লুয়েঞ্জা), কোভিড-১৯, শ্বাসযন্ত্রের সিনসাইটিয়াল ভাইরাস (RSV), রাইনোভাইরাস, অ্যাডেনোভাইরাস এবং প্যারাইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এর মাধ্যমে এই জ্বর হতে পারে।
গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ভাইরাল জ্বর: গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ভাইরাসগুলো অন্ত্র এবং পাকস্থলীতে সংক্রমণ ঘটায়; যা ডায়রিয়া, পেটে ব্যথা, বমি, এবং মাঝে মাঝে জ্বর সৃষ্টি করে। এটা সাধারণত খাবার বা পানির মাধ্যমে ছড়ায় এবং হজমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ রোটাভাইরাস, নোরোভাইরাস, এবং অ্যাডেনোভাইরাস। এই ধরনের জ্বরে পানিশূন্যতা এবং পেটের ব্যথা সাধারণ উপসর্গ, এবং চিকিৎসা না নিলে এই সমস্যাগুলো আরো গুরুতর হতে পারে।
এক্সানথেমেটাস ভাইরাল জ্বর: এই ভাইরাস সংক্রমণ ত্বকে ফুসকুড়ি বা র্যাশ তৈরি করে, যা সাধারণত চামড়ার উপর লাল রঙের দানা বা ফুসকুড়ি আকারে দেখা যায়। এই জ্বর সাধারণত শিশুদের বেশি হয়, তবে বড়দেরও হতে পারে। হাম, চিকেনপক্স, চিকুনগুনিয়া, রুবেলা এবং গুটিবসন্ত এই ধরনের ভাইরাসের উদাহরণ।
মশাবাহিত রোগ: ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া এবং জিকা (Zika)।
হেমোরেজিক ভাইরাল জ্বর: এক ধরণের জ্বর যা বিভিন্ন ধরণের ভাইরাস এর কারণে হতে পারে। এই ভাইরাসগুলো সাধারণত রক্তনালীর দেয়ালকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে রক্তক্ষরণসহ অন্যান্য ওতিল উপসর্গ দেখা যায়। হেমোরেজিক ভাইরাল জ্বরের প্রধান কারণ হিসেবে নিম্ন লিখিত ভাইরাসগুলো দায়ী :
১) ডেঙ্গু ভাইরাস: এটি মশার মাদ্ধমে ছড়ায় (এডিস মশা)। এটি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) এবং ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS) এর কারণ।
২) ইবোলা ভাইরাস: এটি একটি মারাত্মক হেমোরেজিক ভাইরাস যা সরাসরি সংস্পর্শ বা শারীরিক তরল দ্বারা ছড়ায়।
৩) লাসা ভাইরাস: এটি পশ্চিম আফ্রিকায় বেশি দেখা যায় এবং ইঁদুরের মাদ্ধমে ছড়ায়।
ভাইরাল জ্বরের তাপমাত্রা সাধারণত ৯৯°F থেকে ১০৩°F (৩৭.২°C থেকে ৩৯.৪°C) এর মধ্যে হতে পারে, এবং এটি ভাইরাসের ধরনের উপর নির্ভর করে আরও বাড়তে পারে। কিছু সাধারণ লক্ষণ হলো:
উচ্চ তাপমাত্রা: ১০৩°F বা তার বেশি।
গলা ব্যথা বা স্বরভঙ্গ: ভাইরাল সংক্রমণের কারণে গলা ব্যথা হতে পারে।
পেশী বা জয়েন্টে ব্যথা: শরীরে ক্লান্তি এবং ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
ডায়রিয়া বা বমি: গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ভাইরাল জ্বরে পেটে ব্যথা বা ডায়রিয়া হতে পারে।
অবসাদ এবং ক্লান্তি: শরীরের শক্তি হারিয়ে ফেলা ও কাজ করতে কষ্ট হওয়া।
শরীর ঠান্ডা হওয়া: জ্বরের কারণে ঠান্ডা অনুভূতি হতে পারে।
ডিহাইড্রেশন: অতিরিক্ত ঘাম বা ডায়রিয়ার কারণে শরীর থেকে পানি বের হয়ে যেতে পারে।
এগুলো সবই ভাইরাল জ্বরের সাধারণ লক্ষণ। তবে, লক্ষণগুলোর প্রকৃতি এবং তীব্রতা ভাইরাসের প্রকারভেদ অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে।
ভাইরাল জ্বর নির্ণয় করা কিছুটা কঠিন, কারণ এর উপসর্গ অনেক সময় ব্যাকটেরিয়াল জ্বরের মতো হয়। চিকিৎসক প্রথমে আপনার উপসর্গ এবং অসুস্থতার সময় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করবেন, তারপর কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান, যেমন- রক্ত, প্রস্রাব বা সোয়াব পরীক্ষা। কিছু রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড বা চিকুনগুনিয়া শনাক্ত করার জন্য বিশেষ পরীক্ষা করা হয়। ভাইরাল জ্বরের চিকিৎসা ভাইরাস ও উপসর্গের ওপর নির্ভর করে। যদি জ্বর হালকা হয়, ডাক্তার প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন দিতে পারেন। কিছু সময় এন্টিবায়োটিকও দেওয়া হতে পারে। তবে ভুল ঔষধ খাওয়া খুব বিপজ্জনক, তাই নিজে থেকে কোনো ঔষধ খাবেন না। সবসময় চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। এখন ঘরে বসেই চিকিৎসকের প্রেসক্রাইবকৃত যেকোনো ঔষধ অর্ডার করতে পারবেন আরোগ্য অ্যাপে। ভাইরাস জ্বরে Flamex এবং Napa-এর মতো ঔষধগুলো ঘরে বসে অর্ডার করে দ্রুততম সময়েই হোম ডেলিভারি পাবেন আরোগ্য অ্যাপের মাধ্যমে। এছাড়া, জ্বর মাপার জন্য থার্মোমিটার ডিজিটাল ফ্লেক্সিবল টিপও অর্ডার করতে পারবেন ঘরে বসেই।
ভাইরাল জ্বরের চিকিৎসা সাধারণত উপসর্গ কমানোর ওপর ভিত্তি করে, কারণ এতে বিশেষ কোনো থেরাপির প্রয়োজন হয় না। ভাইরাল জ্বর ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট অসুস্থতার মতো এন্টিবায়োটিক দিয়ে সারানো যায় না। চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ
প্যারাসিটামল ব্যবহার (যদি প্রয়োজন হয়)
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা
চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া
ভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সতর্কতা অবলম্বন করা
তরল খাবার এবং হাইড্রেশন
পর্যাপ্ত বিশ্রাম
ঠান্ডা স্পন্জিং
এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করা
পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন।
প্রচুর তরল পান করুন এবং ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখুন।
ব্যথা বা অস্বস্তি এড়াতে নিয়মিত জ্বর বা ব্যথা-নাশক ঔষধ নিন।
সঠিকভাবে অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ নিন।
সহজে হজমযোগ্য এবং পুষ্টিকর খাবার খান।
ভিটামিন সি, জিঙ্ক বা মধু জাতীয় খাবার খান।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন এবং চারপাশ পরিষ্কার রাখুন।
ব্যবহৃত টিস্যু বা সামগ্রী সঠিক স্থানে ফেলুন।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ বা ডোজ গ্রহণ করবেন না।
ডাক্তার না বললে এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করবেন না।
খুব গরম বা ঠান্ডা পরিবেশে থাকবেন না।
অতিরিক্ত কাপড় বা কম্বল ব্যবহার করে ঠান্ডা লাগাবেন না।
ব্যক্তিগত সামগ্রী শেয়ার করবেন না।
ভাইরাল সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য কিছু প্রাথমিক পদক্ষেপ রয়েছে যা ভাইরাসের বিস্তার কমাতে সাহায্য করবে:
নিয়মিত হাত ধোওয়া: এটি ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া দূর করে সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়তা করে।
মুখ ও নাক ঢেকে রাখা: ভাইরাল সংক্রমণের সময়ে বা আক্রান্ত ব্যক্তির কাছে থাকলে মুখ ও নাক ঢেকে রাখা জরুরি।
হাঁচি বা কাশির সময় সতর্কতা: রুমাল বা টিস্যু দিয়ে মুখ ঢেকে রাখুন এবং হাত পরিষ্কার রাখুন।
অসুস্থ ব্যক্তিদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা: অসুস্থ ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ এড়িয়ে চলুন।
স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া: পুষ্টিকর খাবার খেলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ভাইরাল জ্বর খুব সাধারণ হলেও কখনো কখনো গুরুতর হতে পারে। সঠিক চিকিৎসা এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে সহজেই এই সমস্যা মোকাবেলা করা সম্ভব। যদি আপনি ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হন, তবে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
প্রশ্নঃ ভাইরাল জ্বর কি সংক্রামক?
উত্তর: ভাইরাল জ্বর সংক্রামক হতে পারে, যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা, কোভিড-১৯ বা ডেঙ্গু। এটি আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি বা ব্যবহৃত জিনিসপত্রের মাধ্যমে ছড়ায়।
প্রশ্নঃ ভাইরাল সংক্রমণ কাদের প্রভাবিত করে?
উত্তর: ভাইরাল সংক্রমণ যেকোনো বয়সের ব্যক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে, তবে শিশু, বয়স্ক এবং শারীরিক ভাবে দুর্বল ব্যক্তিরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
প্রশ্নঃ ভাইরাল জ্বর ও ব্যাকটেরিয়া জ্বর কি একই?
উত্তর: না, ভাইরাল জ্বর ভাইরাস দ্বারা এবং ব্যাকটেরিয়া জ্বর ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট। ভাইরাল জ্বরের চিকিৎসা বিশ্রাম ও সাধারণ জ্বর কমানোর ঔষধ দিয়ে হয়, ব্যাকটেরিয়া দিয়ে সৃষ্ট জ্বর এর চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়।
প্রশ্নঃ ভাইরাল জ্বর কতদিন থাকে?
উত্তর: ভাইরাল জ্বর সাধারণত ৩-৭ দিন থাকে। যদি ৭ দিনের বেশি সময় থাকে বা পরিস্থিতি খারাপ হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রশ্নঃ কখন ডাক্তার দেখাতে হবে?
উত্তর: যদি জ্বর ৭ দিন ধরে থাকে, বা ১০৩°F (৩৯.৪°C) ছাড়িয়ে যায়, বা শ্বাসকষ্ট, গা গোলানো বা বিভ্রান্তি থাকে, তবে দ্রুত চিকিৎসক দেখানো উচিত।
প্রশ্নঃ ভাইরাস জ্বরে কি গোসল করা যাবে?
উত্তর: ভাইরাস জ্বরে গোসল করা নিরাপদ, তবে হালকা কুসুম গরম পানিতে গোসল করা ভালো। খুব গরম বা ঠান্ডা পানি এড়িয়ে চলুন।
প্রশ্নঃ ভাইরাস জ্বরে কি প্লাটিলেট কমে যায়?
উত্তর: সাধারণত ভাইরাল জ্বরে প্লাটিলেট কমে না, তবে ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া প্লাটিলেট কমাতে পারে। রক্তক্ষরণ বা আঘাত লাগলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
0
0