গভীর ঘুম কীভাবে স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে
ঘুম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। এটি শুধু আমাদের শারীরিক ক্লান্তি দূর করে না, মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষত, গভীর ঘুম বা স্লো-ওয়েভ স্লিপ স্মৃতিশক্তি গঠনে বা বাড়াতে এবং তা দীর্ঘমেয়াদে সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। সম্প্রতি জার্মানির Charité – Universitätsmedizin Berlin-এর একটি গবেষণায় এই বিষয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে।
ঘুম এবং স্মৃতিশক্তির সম্পর্ক
এই গবেষণাটি দেখিয়েছে যে, গভীর ঘুমের সময় মস্তিষ্কের নিউরনের মধ্যে সংযোগ বা সিন্যাপ্স দৃঢ় হয়। এই প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের নিওকর্টেক্স — যা স্মৃতি, ভাষা, এবং কল্পনার মতো মানুষের জটিল জ্ঞানীয় দক্ষতার জন্য দায়ী — গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, গভীর ঘুমের সময় মস্তিষ্কে আপ-স্টেট এবং ডাউন-স্টেট নামে দুটি ধীর গতির বৈদ্যুতিক তরঙ্গ তৈরি হয়, যা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় একবার ঘটে। এই তরঙ্গগুলো নিউরনের মধ্যে সংযোগকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি স্মৃতির স্থানান্তর সহজ করে তোলে।
গবেষণার প্রধান ফ্রান্জ জাভিয়ার মিটারমায়ার বলেন, “গভীর ঘুমের সময়, মস্তিষ্ক বাইরের পৃথিবীর সব ধরণের সেন্সরি তথ্য থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। এই সময় মস্তিষ্ক অতীত অভিজ্ঞতাগুলো পুনরায় খেলে দেখে, যা স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য অপরিহার্য।” তিনি আরও বলেনবলেন, “ঘুমের সময় মস্তিষ্ক বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটি মস্তিষ্ককে অতীত অভিজ্ঞতাগুলো পুনরায় বিশ্লেষণ করার সুযোগ দেয়, যা স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
এই গবেষণায় ৪৫ জন অংশগ্রহণকারীর নিওকর্টেক্স এর টিস্যু নমুনা ব্যবহার করা হয়। এই টিস্যুগুলো বিশেষ পদ্ধতিতে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে জীবিত রাখা হয়, যা গবেষকদের মানব মস্তিষ্কের নিউরন এবং সিন্যাপ্স পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে।
গবেষকরা জানান, “যেহেতু অনেক গবেষণাই পশুদের উপর করা হয়েছে, তাই মানব মস্তিষ্কের ঘুমের প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের বোঝাপড়া এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। তবে এই গবেষণা ভবিষ্যতে স্মৃতি সংক্রান্ত রোগ যেমন ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমারের মতো সমস্যাগুলো মোকাবেলায় নতুন পথ দেখাবে।”
কীভাবে গভীর ঘুম স্মৃতি তৈরি করে
গভীর ঘুমের সময় মস্তিষ্কে আপ-স্টেট এবং ডাউন-স্টেট নামে পরিচিত দুটি অবস্থার মধ্যে পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন প্রতি সেকেন্ডে প্রায় একবার ঘটে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই পরিবর্তনগুলো মস্তিষ্কের নিউরনের সংযোগকে শক্তিশালী করে।
যখন মস্তিষ্কের এই আপ-স্টেট এবং ডাউন-স্টেট এর মধ্যে পরিবর্তন ঘটে, তখন হিপোক্যাম্পাস, যেখানে স্বল্পমেয়াদি স্মৃতি জমা থাকে, সেই স্মৃতিগুলোকে নিওকর্টেক্স-এ প্রেরণ করে। এর ফলে সেগুলো দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষিত হয়।
বয়স ও স্মৃতি সংরক্ষণে ঘুমের ভূমিকা
ডিমেনশিয়া এবং আলঝেইমারের মতো রোগের ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার একটি বড় কারণ হলো গভীর ঘুমের ঘাটতি। বার্ধক্যে অনেকের ঘুমের গুণগত মান কমে যায়, যা স্মৃতি সংরক্ষণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ডা. ভার্না পোর্টার, যিনি স্মৃতিশক্তি ও ডিমেনশিয়া নিয়ে কাজ করেন, এই গবেষণাকে “চিন্তা-উদ্রেককারী ও উত্তেজনাপূর্ণ” বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “গভীর ঘুমের সময় ধীর গতির তরঙ্গ স্মৃতি সংরক্ষণ প্রক্রিয়াকে দৃঢ় করে তোলে। এটি বোঝা, ডিমেনশিয়ার মতো রোগ প্রতিরোধে আমাদের নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে।”
উপসংহার
গভীর ঘুম শুধু ক্লান্তি দূর করে না, এটি আমাদের মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত ভালো ঘুমের অভ্যাস গড়ে তোলা শুধুমাত্র শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই, মানসম্মত ঘুম নিশ্চিত করা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হওয়া উচিত।
1
0